সাইরেন!

আলমগীর মাহমুদ ◑

ভব সংসারে ভাগ্যবান মনে করি তাঁকে। যে সামর্থকালীন সময়ে তার ভালবাসা পরীক্ষার সুযোগ পেয়েছে । ও মনে হয় আমারে ভালবাসে । ওর পছন্দের মানুষ আমি। এমন ভাবনার রঙ্গিন ফানুসেই দিন কাল বছর বাড়ে ।

হাসপাতালে করোনা আক্রান্তের দিনে যখন কেউ নেই আর। আক্রান্তের ভয়ে হাসপাতালের ট্রলিওয়ালা গাইব, তখনই যিনি “দেশ মইরা গেছে বহুত আগে, তর বাপ মরে নাই এহনও ” আয় বলে করোনা আক্রান্ত পুত্রকে কাঁধে নিয়ে ডাক্তারের খোঁজে হাঁটতে রয় সেইই বাবা…..

আজ ১৭ ই রমজান আমার মনোমন্দিরে বেজে উঠে সাইরেন ” আজ যে আমারও এমন একজনের মৃত্যুদিন।

ফরেষ্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে অবসর নিয়ে বাবা উনার পিতৃভূমি উখিয়া উপজেলার রত্নাপালং বসত গড়েননি। ছেলেরা কক্সবাজার বি,ডি,আর ক্যাম্প এলাকায় বসত গড়াতে উনি কক্সবাজার সদর উপজেলার পাশাপাশি জমি কিনে কুটির বানিয়েছিলেন।

চিন্তা একটি। এখান থেকে প্রত্যেক দিন হেঁটেই আমার ছেলেদের বাড়িঘরে যাওয়া যাবে।

১৭ রমজান। রোজা ছিলেন। সকালবেলা সেভ হন। লিংকরোড বাজার থেকে বাসার বাজার করে বাড়িতে প্রতিবেশীদের সাথে হাস্যরস করে গোসল সারেন।

জোহর নামাজের জন্য পাঞ্জাবী পরেই হঠাৎ উনার বিছানায় বসে পড়েন। বালিশ টেনে বালিশে হেলান দেন। হঠাৎ মাথাটা সামান্য ডান কাতে হেলান মুখে ফেনা। অচিন পাখি আর খাঁচায় নেই।

মৃত্যুর বেশ ক’দিন আগে থেকেই বাবা একটা নান্দনিক পাটি কিনতে অস্থির হয়। সবাই অবাক বনে। উনি পাটি কিনতে কেন মরিয়া?

কক্সবাজার বেশ সুপুরুষের বিজয় কেতন উড়ানোব মত উনি আমার ছোট মা’কে সাথে নিয়ে রিক্রিয়েশন টুরের মত বেরিয়ে পড়েন পাটি কিনবে। বিশেষ সাঁজুগুজো ।

সবাই বেশ রসিয়েই নীরব হাসিতে স্বাদ মিঠাইল। কেউ কারো কিছুই কইল না। আর যারা আবেগ রাখতে পারেনি তারা কইল “আব্বাই সুখী মানুষ ‘

“সুখ ভোগ করতেও সুখ ভোগের কৌশল জানা লাগে, পাছে লোকে কিছু বলবে ভাবলে দুনিয়ার সব সুখ কয়েদী বনেই রয়” ।

বাসায় ফিরে ছোট মা বেশ রসিকতায় ফোনে কয় ” আজ তোমার বাবার কান্ড দেখে মানুষ শুদ্ধ হাঁসতেছে। অনেক জায়গা ঘুরলাম । সাগর পাড়ে চাইনিজের দোকানে ঢুকায়। অনেক অনুরোধ করি পেনশনের মাসের পাওনা যাহ! তাহ কি কুলোবেরে!

এরপর ভয় দেখাতে বলেছি ছেলের বউ, জামাই নাতি সবাইর জন্য কিনে দিতে পারলেই ঢুকব। রাজি হয়। সবাইর জন্য কেনে। দু’জনে রসনা পুরিয়ে খাই। ফিরতি পথে কইল ”এইসব ভেবে কাঁদিস না!.. বলে হেসে উঠল।

এরপর গেল পাটির দোকানে চার পাঁচহাজার টাকা পাটির দাম। কোনমতেই নামে না। তোমার বাবা তারপরও কিনতে রাজি আমি জোরালো বাঁধ সাধি উনি রাগলেন না । শুধুই কইল ”মহিলারা শুধু টাকা বুঝে” বলে গাড়ি নিয়ে বাসামুখী হলাম।

এরও এক দুইদিন পর। বাবা একা গিয়ে একটা পাটি হাতে দরজায় দাঁড়িয়ে ছোট মা”কে দেখিয়ে বেশ আবেগ ঘন ভাষায় কয় “এই পাটি কেন কিনছি জানিস সেদিন তোর বোনের জামাইর মৃত্যুতে মাঝে মুর্দা দূপাশে হাফেজ ছেলেরা বসে কোরান পড়ার দৃশ্যটা আমার বেশ মন ছূঁয়েছে সেদিন থেকেই আমার একটা পাটি কিনতে ইচ্ছে করছিল ।

তোর জন্য ঐদিন কিনতে পারলাম না। তাই একা গিয়েই এই পাটি কিনে এনেছি , দেখিস এই পাটিতে বসে কাঁদবি না । এই পাটিতে শুয়ে আমি কোরানের আওয়াজ শুনবো শুধু। বারে বারে তরে নিষেধ করে গেলাম ” এই পাটিতে বসে কাঁদবি না কখনও।।

বাবার প্রত্যেক মৃত্যুর দিনে মা পাটিটা বের করে ধূয়ে নেন চোখের জলে। আওড়ান সুখ টুরের সব স্মৃতি। বিলাপে বিলাপে হাতড়ান পাটিটা, বুকে নেন, কপালে লাগান। অঝোর নয়নে কাঁদেন এ যেন মেহেদীপাতার সবুজে আরেক পৃথিবী .. সাঁজানো কাপড়ে মোড়ানো দেহে নীরব ‘সাইরেন’……

লেখকঃ বিভাগীয় প্রধান (সমাজবিজ্ঞান বিভাগ) উখিয়া কলেজ, কক্সবাজার।
ইমেইল – alamgir83cox@gmail.com